বাংলাদেশে মেরিটাইম শিক্ষা

marine academy_image

যুগ যুগ ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক অমূল্য ভূমিকা রেখে আসছে মেরিটাইম বিভাগ। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে বলেই মেরিটাইম শিক্ষায় আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশ একটি মেরিটাইম সমৃদ্ধ দেশ হতে হলে এই খাতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি এবং সঠিক দিকনির্দেশনা।

ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ থেকেই সমুদ্র বাণিজ্য ও জাহাজ তৈরির মতো মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বিশেষভাবে দক্ষ থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৯৫২ সালে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট; ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি; ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমি যাত্রা শুরু করে।

ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট(এন এম আই): ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের গোশাইলডাঙ্গায় ছোট পরিসরে শুরু হলেও পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ইপিজেড ও মাল্টি পারপাস বার্থ জেটির মর্ধবর্তী স্থানে স্থায়ীভাবে নির্মিত হয়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ৯৪৭৬ জন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রাক-সমুদ্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।১৯৯৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৮৬২ প্রাক-সমুদ্র-রেটিং এবং ৮৩৭৯ উত্তর-সমুদ্র-রেটিং / অফিসারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি(বি এম এ): ক্যাম্পাসটি কর্ণফুলি নদীর পূর্ব তীরে চট্টগ্রামের জুলদিয়ার উপত্যকায় অবস্থিত। ২২ নটিক্যাল ক্যাডেট অফিসার এবং ২২ মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডেট অফিসারদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে প্রকল্পিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে নির্মিত হয় এই ক্যাম্পাস। এই প্রতিষ্ঠান দক্ষতার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা হিসাবে ইংরেজীসহ একটি রেজিমেন্টাল, আবাসিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ক্যাডেটদের স্নাতকোত্তর করে তোলে আইএমও এসটিসিডাব্লিউ কনভেনশন দ্বারা। বর্তমানে, প্রায় ৪৩০০ প্রি সী ক্যাডেট ও ৪৫০০০ পোস্ট সি অফিসার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিগত ২০১২ সাল হতে পুরুষসহ মহিলারাও জাহাজী হওয়ার লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত হচ্ছে এখানে।

উল্লেখ্য, সরকারীভাবে চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশে বরিশাল, পাবনা, সিলেট এবং রংপুরে আরও চারটি নতুন প্রতিষ্ঠিত মেরিন একাডেমি সংযুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমি (বি এম এফ এ): চট্টগ্রামের বিপরীতে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত মেরিন ফিশারিজ একাডেমি। তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের সহযোগিতায় ফিশিং বহরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাই ছিল এর লক্ষ্য। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বি এফ ডি সি) প্রকল্প হিসাবে কর্মরত এই একাডেমি। এ পর্যন্ত(৩৬ তম ব্যাচ) ১৮০০ ক্যাডেট স্নাতক হয়েছে; প্রায় ১২০০ ক্যাডেট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। ২০১০ সাল হতে এ প্রতিষ্ঠানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলা ক্যাডেট যোগদান করে এবং উভয়ই নীল অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

সরকারী ছাড়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম একাডেমি(আই এম এ), বাংলাদেশ মেরিটাইম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (বি এম টি আই), ওয়েস্টার্ন মেরিটাইম একাডেমি (ডাব্লিউ এম এ), এম এ এস মেরিটাইম একাডেমি প্রভৃতি।

মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়: আমাদের দেশে মেরিটাইম খাতে প্রশিক্ষণ এর পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও উচ্চ শিক্ষা বা গবেষণার জন্য বরাবরই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় যা বেশিরভাগের জন্যই কষ্টসাধ্য। মেরিটাইম শিক্ষাকে সহজ ও প্রসারের উদ্দেশ্যেই ২০১৩ সালে ঢাকার মিরপুরে স্থাপিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়’, যা বাংলাদেশের ১ম, বিশ্বের ১২ তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৩য় মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। এর স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ চলছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হামিদ চর এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে ১০৬.৬৬ একর জমিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ টি অনুষদের আওতায় থাকবে ৩৮টি বিভাগ ও ৪ টি ইনস্টিটিউট। বর্তমানে অনার্স এর জন্য ওশানোগ্রাফি, নেভাল আর্কিটেক্চার ও অফশোর ইন্জিনিয়ারিং সহ মেরিন ফিশারিজ বিভাগ গুলোতে বি এস সি, পোর্ট ম্যানেজমেন্ট ও লজিস্টিক্স বিভাগে বি বি এ ও মেরিটাইম আইনে এল এল বি চালু আছে। অন্যদিকে, বিশদভাবে মেরিটাইম সায়েন্স, পোর্ট ও শিপিং ম্যানেজমেন্ট, মেরিটাইম বিজনেস,মেরিন বায়োটেকনোলোজি, মেরিন ট্যুরিজম ও হস্পিটালিটি, মেরিটাইম ডেভেলপমেন্ট ও স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ এ মাস্টার্স সহ মেরিটাইম আইনে এল এল এম করার সুযোগ রয়েছে। ব্যবহারিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক শিল্প ও সংস্থাগুলিতে শিল্প ভ্রমণ, ফিল্ড ট্রিপ, ভিজিট এ নেয়া হয়। এছাড়া, বিদেশী গবেষক, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ দ্বারা বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজিত হয়।

মেরিটাইম সংশ্নিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন মেরিন একাডেমি, ফিশারিজ একাডেমির স্নাতক কোর্স মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ ক্যাডেটরা সহজেই এখানে উচ্চশিক্ষিত হতে পারবে। যার মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণা খাতেও দক্ষ মানবসম্পদ লাভ করবে বাংলাদেশ।

মেরিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি(এম আই এস টি) ও নারায়ণগঞ্জের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে মেরিন বিষয়ে শিক্ষালাভের ব্যবস্থা আছে।

পরিশেষে বলতে বাধ্য, জল ও স্থল-কোথাও থেমে নেই আজকের মেরিটাইম লিডাররা। আধুনিক শিক্ষার ধারায় শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ এই জনবলের হাত ধরেই উন্নতর হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় ও নীল অর্থনীতি।

Fahad
লেখকঃ রবিউল হাসান ফাহাদ

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে